-->

জীবন শিল্পী অনিল ঘড়াইয়ের শিল্প সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব - চঞ্চল কুমার মণ্ডল

 

জীবন শিল্পী অনিল ঘড়াইয়ের শিল্প সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব - চঞ্চল কুমার মণ্ডল

জীবন শিল্পী অনিল ঘড়াইয়ের শিল্প সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব

চঞ্চল কুমার মণ্ডল

আমাদের জাতীয় জীবনের যা কিছু পরিবর্তন সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজন, আর্থিক দৃষ্টি কোনে মানুষকে মূল্য দেওয়া, তীব্র বেকার সমস্যা, আজকে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। জটিল আর্থ সামাজিক সংকটে মানব জীবন আজ বিভ্রান্ত; রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত। সাহিত্যে তারই প্রতিফলন কতখানি বাস্তবোচিতভাবে ঘটেছে তা লক্ষ্য করার বিষয়।

বিশ শতকের প্রথম পঁচিশ ত্রিশ বছর বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-শরৎ নিরঙ্কুশ ভাবে আধিপত্য লাভ করেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরবর্তীকল্লোল’ ‘কালিকলম’ - পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নবীন লেখক কুল সাহিত্যে নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের উত্তরাধিকারকে বহুলাংশে অস্বীকার করেন। জীবনকে তারা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেন। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মনীশ ঘটক, প্রবোধ কুমার সান্যাল প্রমুখ সাহিত্যিকগণ তাঁদের জীবন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাকে নতুন দৃষ্টিতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেন। এঁদের রচনায় নারী জীবনের জটিলতার ছবি সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। এতদিন কার রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের হাতে আঁকা বাঙালী নর-নারীর দাম্পত্য জীবন সংকট এঁদের হাতে এসে নতুন পথে বাঁক নেয়। এঁদের হাতে এসে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের বিশ্বাস যোগ্যতা এমনকি নরনারীর শরৎ-বঙ্কিম নীতিদর্শি শুচিতার প্রশ্নটির গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের উপকেন্দ্রিক মনোভাবের প্রভাবে যুদ্ধোত্তর কালীন বাঙালী পারিবারিক জীবনের প্রচণ্ড ভাঙন ও বিপর্যয়ের ফলে নরনারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার এঁদের রচনার প্রধান উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে। প্রবোধ কুমার সান্যালেররঙীন সুতো’, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তেরবিবাহের চেয়ে বড়এরূপ বহু উপন্যাসে নরনারীর সম্পর্কের অতিবার দেখা যায়। তবু এই পর্বের উপন্যাসের জীবনায়ন মৃত্তিকা স্পর্শী, বাস্তবের ধূলি মলিনতায় জারিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল, যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ প্রেমেন্দ্র মিত্রেরপাঁককিংবামিছিলপ্রভৃতি উপন্যাসে। নগরায়নের চিত্র ফেলে অতিবাস্তবতাকে ছুঁতে চেষ্টা করেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তহাঁড়ি-মুচি-ডোমউপন্যাসে। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কয়লা কুটির দেশউপন্যাসে কয়লা খনি কেন্দ্রিক বস্তি জীবনের বাস্তবতা ছুঁতে চেষ্টা করে সমাজের অন্ত্যজ তথা দলিত-ঘৃণিত-চির অবহেলিত শ্রেণীর মানুষের জীবনচিত্র আঁকেন। তবুও এই পর্বের লেখককুল যতই রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের রচনার বৃত্ত থেকে সরে এসে মৌলিক রচনার ধারা স্রোত এনে স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করার চেষ্টা করুন না কেন; বাংলা উপন্যাসের গতিপথকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাবে নতুনতর পটভূমিতে উপস্থাপন তথা নতুন কোনো ইতিবাচক দিগন্তে প্রসারিত করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা এঁদের ছিল না। যদিও কথা সাহিত্যে এঁরা একটা আলোড়ন তুলেছিলেন কিন্তু সেই আলোড়ন-বিক্ষোভকে কোনো খাতে প্রবাহিত করে দেওয়ার মতো মানসিকতা এঁদের ছিল না; কিম্বা অভিজ্ঞতার ভাব ছিল এমনটাও হাতে পারে। তবুও ঐ সময়ে অন্ত্যজ সমাজের নিষ্পেষিত-দলিত শ্রেণীর মনুষ্য জীবনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাহসিকতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। (পূর্ব উক্তপাক’, ‘হাঁড়ি-মুচি-ডোমযার উজ্জ্বল উদ্ধার)।

বাংলা উপন্যাসের নতুনত্বের ক্ষেত্রে ঐ অপূর্ণতাকে যারা দূর করার ব্রতী হয়ে এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় তিন বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণ। এঁদের আবির্ভাবকল্লোল’ - ‘কালিকলমকাল, তথা ১৯২৯-৩০ সাল থেকে। এঁদের রচনার বিষয় বস্তু নগর জীবন ঝেড়ে ফেলে হয়ে ওঠে একেবারে গ্রাম কেন্দ্রিক অনগ্রসর তথা সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত চিরদলিত ঘৃণিত শ্রেণীর মানব গোষ্ঠীএঁদের রচনায় জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নতুনত্ব লাভ করে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষত বীরভূম অঞ্চলের গ্রাম জীবনের অতি সাধারণ শ্রেণী বেদিয়া, বাজিকর, সাঁওতাল, বৈষ্ণব, আউলবাউল, তান্ত্রিক প্রভৃতি রহস্যময় মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে আমাদের এতদিনকার অভিজ্ঞতার বাইরে লুকিয়ে থাকা অজ্ঞাত জীবনের পরিচয় দিলেন। এই ধারা স্রোতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আরও কিছু নতুনত্বের সঞ্চার করেন। আবার বিভূতিভূষণ মায়াময় রহস্যে ঘেরা কবিত্ব পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে পল্লী জীবনের প্রকৃতি নির্ভর মানুষের জীবন ছবি এঁকে প্রচলিত ধারা স্রোতে থেকেও বিশিষ্টতা দান করেন। সৃজন করেন প্রতিটি রচনার মৌলিকতা। তাঁর উপন্যাসে নেই এতদিন কার প্রচলিত কথা সাহিত্যে রচিত হয়ে আসা সমাজের জ্বলন্ত সমস্যার কথা, নেই সেই সব মানুষ যারা নানান ব্যক্তি সংকট ও সামাজিক আবেগ - সংস্কারের টানাপোড়েন বিক্ষত, - অন্তর্দ্বন্দ্বে ও বিচিত্র সংঘাত আবর্তের জটিলতার দ্বারা ছিন্নভিন্ন। আসলে জীবনকে সরাসরি নির্দিষ্ট কালের আয়নায় প্রতিফলিত করে যুগোপযোগী সামাজিক অনাচার কিংবা ত্রুটি বিচ্যুতির বিশ্লেষণ তার সাহিত্য সাধনার অভিপ্রেত ছিল না। সামাজিক অন্যায় - পাপাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিক্ষোভ, বাদ-প্রতিবাদ ব্যঙ্গের মাধ্যমে পরিস্ফুট করে তোলার মতো মানসিকতা তাঁর ছিল না।

পশ্চিমী দুনিয়ার উন্মার্গগামী জীবনাদর্শ, পাশ্চাত্য সাহিত্যিক তথা ল্যুটহামসুন, ডি. এইচ. লরেন্স প্রমুখদের কথাসাহিত্যের প্রভাবে ভোগ সর্বস্বতা এবং দেহবাদের অতিরিক্ততা, সাম্যবাদী রাজনৈতিক আদর্শের ঢেউ এমনকি মধ্যবিত্ত বাঙালীর নগরমুখী মনোভাব তথা নাগরিক জীবনাদর্শের প্রতি আত্যন্তিক পক্ষপাত বাঙালী পাঠককে এতদিন স্বপ্নের কাল্পনিক রঙীন স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তাদের রচনায় চাপা পড়েছিলো সেই অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্র কিংবা তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণের পরবর্তী কিছুকাল গ্রাম জীবনের বিপর্যয়তার ছবি। দলিত নরনারীর বিক্ষুব্ধ জীবনাদর্শ। যদিও অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, শৈবাল মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর সহ অসংখ্য নবারুণ কথা সাহিত্যিকবৃন্দ সেই স্রোত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন তথাপি অদ্বৈমল্ল বর্মণ ও মহাশ্বেতা দেবীর হাতে ব্রাত্য জীবন জীবন্ত রূপ পায়।। বাঙালী পাঠক মন নগর জীবন কেন্দ্রিক জীবনাদর্শের চোরাস্রোত কাটিয়ে যেন অতিচেনা বাস্তবের খণ্ড লোকে ফিরে আসতে শুরু করে। তৈরি হয় চতুর্থ দুনিয়ার ফসল -চোট্টিমুণ্ডার তীর; ‘তিতাস একটি নদীর নামব্রাত্য জীবনাশ্রিত চতুর্থ দুনিয়ার ফসল। আরও পরিপূর্ণ রূপ লাভ করতে থাকে বর্তমান গ্রাম্যজীবনে বেড়ে ওঠা এমনকি গ্রাম জীবনের ব্রাত্যজনের প্রতিভূ পুরুষ তথা আজকের দলিত সাহিত্যিক অনিল ঘড়াই। তাকে দলিত সাহিত্যিক বললাম কারণ, অনিলের ব্রাত্যজনকে নিয়ে সৃষ্টি অসংখ্য কথামালা সামান্য কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মানের তালিকায় সঠিক মূল্য যাচাই হয় না।

তাঁর সাহিত্য-শিল্প প্রকরণ নিয়ে কেন মিডিয়ারা প্রচারের আলোয় আনতে এত অনীহা?  কেন তার সাহিত্য অন্যান্য অসংখ্য সৃষ্টি মালার সঙ্গে তুল্য মূল্য যাচাই হয়ে ওঠেনি আজওকেন তার সাহিত্য আজও ব্রাত্য? অবহেলিত? নামগোত্রহীন অতি দীন-হীন নগণ্য ফুল হিসাবে কেন দৃষ্টির আড়ালে চাপা পড়ে আছে? তার অমূল্য এই সকল অসংখ্য সৃষ্টিমালা যদি না সঠিক মূল্য পায়, যদি না সঠিক জহুরির চোখে ধরা পড়ে, তাহলে তো আমরা সেই নগর কেন্দ্রিক কৃত্রিম মেকী-মানবতাবাদকেই স্বীকার করে নিলাম। অনিলের সাহিত্য তো একরকম সেই চোরাস্রোত কাটিয়ে ওঠার লড়াই। সুবিধা বাদী কিছু গোষ্ঠী তাএই কৃতিত্বকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আমার বিশ্বাস কোনো দিনও চেপে রাখা যায় না আগুনের ফুলকি। সমস্ত প্রতিকূলতার ঘন কুয়াশা ছিন্ন করে একদিন তার সাহিত্যর এই বহ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়বে সাহিত্যের সমগ্র পাঠক মহলে। সেদিন মফঃস্বল সাহিত্যিকগণও এই গ্রাম্য অন্ত্যজ সাহিত্যিকে তাঁদে সাধনার ধন হিসেবে সাদরে আহ্বান জানাতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। দেশকে-দেশের সাহিত্যকে যেখানে তিনি বেঁধে ফেলেছেন তা আগামী দিনের পাঠক এই মহতী সাহিত্য সাধনার প্রচেষ্টাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে বরণ করে নেবে। কালের অক্ষরে মুদ্রিত তার সৃষ্ট চরিত্র সকল যুগ-যুগ লড়াই করে যাবে সমাজের সমস্ত শোষণ বঞ্চনা-অন্যায়-অত্যাচার-পাপাচারের বিরুদ্ধে। আকাশ মাটির খেলাগল্পের সুদামা, কুঙ্কল, নিবিড় অরণ্যবারী, মরা, গুরুবারি যাযাবর বিন্দিয়া। জলচুরুনীগল্পের পথকুড়ো, ‘উরাংগাড়াগল্পের বুদনী ভারতীয় মানচিত্রে জেগে থাকা এই সকল অসংখ্য জীবন্ত চরিত্রের মধ্য দিয়েই তার সৃষ্টি প্রকরণ চির উজ্জীবিত হয়ে থাকবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বুধারাম, ভাতি, ময়না, কানু, হাস্তরি, মুচিয়া, ঈশ্বর, কার্তিক, বিরিজ, ফেলনা, কদমা, বাসমতি, কুনু, বিন্দিরা, ভানুমতি, রামকল্প, নোনা সামাড, দশরথ, জগাই, ভোগী, তুনিয়া, মিয়া, সামারু, নিধু, বাদলা, কুসুম ও তার মা, পুতলি, সনাতন, ভাকুয়া, বুদনী সহ অসংখ্য সমাজের অন্ত্যজ-নির্বাক সম্প্রদায়ের চরিত্রদের ভীড় তাঁর কথা সাহিত্যকে কেবল বৈচিত্র্যময় করে তোলেনি, পাঠক মনে এই সকল চরিত্র কালের অক্ষরে ভীড় জমিয়ে থাকবে। সময়ের চোরাস্রোত পেরিয়েও পাঠক মনকে ভাবিয়ে তুলবে আজও কি সুদামা - বিন্দিয়া স্বর্ণগর্ভা মৃত্তিকা থেকে মাটি খুঁড়ে সোনা খুঁজে চলেছে? হাভাতি কেমন? ময়না কেমন? হাঞ্চারি কেমন করে তাদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে চলেছে! বাদলা-পুতলির উদর সংস্থান আজও ঘটেছে কি? নিধু ডোম আজও কি লাশ বয়ে চলেছে? বাসমতির জীবন জটিলতা মুক্ত হয়েছে কি? শরৎচন্দ্রের গফুর, আমিনা, কাঙালী, রমা, রমেশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কুসুম, কুবের-কপিলা, শোদা, তারাশঙ্করের রাইকমল, রাধা, বিভূতিভূষণের দুর্গা-সর্বজয়া প্রভৃতি চরিত্রের মতো অনিলের ঐ সকল অসংখ্য দলিত শ্রেণীর চরিত্রেরা অমর হয়ে রইল সৃষ্টির অক্ষর মালায়।

তার কৃতিত্ব কেবল ব্রাত্য জীবন কেন্দ্রিক রচনার জন্যেই নয়, - শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর এমনকি বিভূতি ভূষণের জীবন দর্শন তার সাহিত্যে প্রতিফলিত হলেও, তার রচনার মৌলিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ জাগে না পাঠক মনে। তার রচনায় তারাশঙ্করের জীবনাদর্শের ছায়া কাটিয়ে ওঠার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিভূতি ভূষণের ধূসর অথচ কবিত্বময় স্বপ্নভূমি কাটিয়ে জীবনের রুক্ষ-কঠিন বাস্তবতাকে ভাষ্যকারের মতো চিত্রের পর চিত্রে রূপ দিয়ে গেছেন। প্রত্যেক শিল্পী কবির জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু স্বতন্ত্র, তাই বলা যায় - অনিল ঘড়াইয়ের সৃষ্টির মৌলিকতা রচনার বিষয় বস্তুকেই নয়, আবার জীবনকে দেখার দৃষ্টি ভঙ্গিতে কেবল নয়। রচনা শৈলীর নতুনত্বে এবং অভিনয় সাহিত্য দীপ্যমান। অঞ্চল কেন্দ্রিক চরিত্র নির্ভর ভাষা সাযুজ্য যা লেখকের সাত বদ্ধির ছটা, নূতন নতন শব্দ তৈরির তীক্ষ্ণ মেধা-এমনকি চেষ্টালব্ধ মণ্ডন নৈপুণ্যে সব অন্ত্যজ মানুষের জীবন বৈচিত্র্যের নিদারুণ গূঢ় গভীর অভিজ্ঞতা বর্ণময় করে, যা তার একান্ত নিজস্ব মৌলিকতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

গ্রামীণ ঐতিহ্যের যথার্থ উত্তরাধিকার অনিল ঘড়াই ও তাঁর সাহিত্যের বেদভমি। বিশ্বাস প্রবণ শিল্পী মানসের যাদু স্পর্শে আজ বাঙালী পাঠককুলও উদ্বেলিত। বিচিত্র মানবেন বৈচিত্র্যময় জীবন যন্ত্রণার নিদারুণ কষ্টের আঁচ বুকে চেপে সাহিত্যে চিত্রিত করলেও সেই আঁচ লেগে পাঠক হৃদয়ও তপ্ত হয়ে ওঠে। নাগরিক মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে ফিরে তাকানর সময় এসেছে বাঙালী পাঠক সমাজের। তাঁর সাহিত্য পাঠে জীবনকে ভালোবাসার, বিচিত্র সব কঠিন জটিল জীবনের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে তাদের কাছে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বাঁচার কৌশল শিখে নেওয়ার সময় এসেছে। বিনোদন সাহিত্য কুশিলবদের কাছে এই অভিজ্ঞতা হয়তো গোলমেলে বানানো কাল্পনিক অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তারা আসলে জীবনের রিক্ততাকে পছন্দ করেন না। যে সব অভিজ্ঞতা। আমাদের ব্যথিত করে, ক্ষুব্ধ করে তা তারা এড়িয়ে থাকতে, বাঙালী পাঠকদের সরিয়ে রাখতে চান। তাঁরা বার-বার সাহিত্যে দেখাতে চান জীবন যে কত মধুর-স্বপ্নিল-সুন্দর জগৎ সেই জগতেই পাঠকদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু নিত্য ভঙ্গুর দুর্লভ জীবনকে এড়িয়ে গিয়ে সাহিত্যকে বিনোদন করে বাস্তবকে অস্বীকার করা যায় না। এ প্রসঙ্গে সেকালের এক বিশিষ্ট লেখক মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় এর উক্তিটি উল্লেখযোগ্য মনে করি— “মানুষের জীবনে খাওয়া শোওয়ার মতো ব্যবহারিক ব্যাপারের মধ্যে আধুনিক সাহিত্য যদি রস আহরণ করে থাকে তো বুঝব আমাদের সত্যের ক্ষুধা জেগেছে। আমরা আর শিব-সুন্দরকে কল্পনার বাসর ঘরে। বসিয়ে রেখে অলীকের গান শুনিয়ে তৃপ্ত থাকতে পারছিনে।

সুতরাং অনিল ঘড়াই এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে গ্রাম জীবন ও তার জটিল আর্থ সামাজিক সংকটের যথার্থ রূপকার। গ্রাম জীবনের অন্ত্যজ নরগোষ্ঠীর লৌকিকও অপ্রাকৃতিক সংস্কার বিশ্বাস কিভাবে তাদের দুর্ভাগ্য জনক জীবনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে সেই অন্ধকারময় অনগ্রসর নিপীড়িত জীবনের চালচিত্র শিল্পিত রূপদানের সাথে সাথে নূতন কালের অনিবার্য পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে বাস্তবতাবোধ ও সামগ্রিক জীবন বোধের পরিচয় দিয়েছেন তার অসংখ্য গল্প-উপন্যাসের এই অন্ত্যজ নর-নারীর জীবনচিত্র অঙ্কনের সৃষ্টির পরতে পরতে। তাঁর লেখনী রীতি বৈচিত্র্যময়। সমাজের নীচু তলার মানুষকে তার সাহিত্যের বেদভূমিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন পুঁথি নির্ভর জ্ঞানে নয়, কোনো সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে নয়, একজন দরদী হৃদয়বান বিবেকী সত্তারই নরগোষ্ঠীর থেকে উঠে আসা তাদেরই জীবনের শরিক হিসেবে