যেমন দেখেছি তাঁকে - অনিল আলোয়
সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী যে সাহিত্য আন্দোলনের ধারা গড়ে উঠেছে – যা, ‘দলিত
সাহিত্য আন্দোলন’ নামে ইতি মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করেছে – তার মূল ভিত্তিই হলো
বিপুলায়তন জীবনাভিজ্ঞতা। যার জোরেই এই সাহিত্য ধারায় দলিত সাহিত্যিকদের সৃষ্ট
প্রখরতর বাস্তবতার স্তরে উন্নীত হয়। এই আন্দোলনের মূল কথা হল – কল্পনার বাস্তবতা
নয়, জীবনের বাস্তবতাই এর শেষ কথা। ফলে, এই পর্যায়ের সাহিত্যধারা আত্মজৈবনিক
উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। যেখানে রবীন্দ্রনাথও মাটির কবির কাছাকাছি থেকে কল্পনাকে
ক্রমে দূরে সরিয়ে জীবনাভিজ্ঞতাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। অনিল ঘড়াই সেই
জীবনাভিজ্ঞতার জোরেই মানুষের অন্তর্মুখী পুরুষার্থকে বাইরের বঞ্চনা, শোষণ,
অবমাননা-নিপীড়ন আর সংগ্রাম ও সমারোহের
আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অন্বেষণ করেছেন, অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে ফিরেছেন।
মানুষের অন্তর্লোকের গহন-গোপন রহস্য উন্মোচনে, অভিজ্ঞতার আলো ফেলে খুঁজে ফিরেছেন।
সমাজনীতি-অর্থনীতি ও রাজনীতির পটভূমির ভেতর দিয়ে শিল্পী তাই চূড়ান্ত সিদ্ধি ও
সফলতার পথ ধরে এগিয়েছেন। যে সমাজনীতি ও অর্থনীতির ভেতর দিয়ে ধরা পড়েছে নিচুতলার
শোষিত মানব জাতীর লোকাচার, কৃষ্টি-সংস্কৃতি এমনকি লৌকিক জীবন ব্যবস্থাও।
অনিল ঘড়াইয়ের গল্পশৈলী বাংলা
সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যময়। গল্প-কথা
পরিবেশনে নেই কোনো উত্তর আধুনিকতা। প্রান্তিক মানুষের চলমান জীবন ধারার সাথে
রাজনীতি-সমাজনীতি ও অর্থনীতির পারি-পার্শ্বিকতা সু-কৌশলে গল্প মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সুডোল -
নিটোল গল্প কথায় এমন সব জীবন চিত্র ফুটিয়ে তোলেন; - যা, পাঠক মন ঐ গল্পরস
আহরণে বিন্দুমাত্র টোল খায় না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎপরবর্তী মহাশ্বেতা
দেবীদের যথার্থ উত্তর সূরী হিসেবে অনিল ঘড়াই অন্ত্যজ শ্রেণীর বিচিত্র পূর্ণ
নাঙ্গা-খোঁড়া মানুষের অন্দর মহলে ঢুকে পড়ে ঐ সকল মানুষের চিরায়ত আদি
সংস্কার-বিশ্বাস, জড়তা, ভয়, গ্লানি; এমনকি, অসংখ্য ঐ গোষ্ঠীবদ্ধ নিপীড়িত জীবনের
জাতীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন তাঁর বিপুলায়তন সৃষ্টির ক্যানভাসে। অদ্বৈতমল্ল বর্মণও
অন্ত্যজ কুলে জন্মে ঐ দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে মালোদের জীবন চিত্র
পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। আবার,
সমকালে ঐ দলিত সাহিত্যের ধারা স্রোতে এগিয়ে এলেন ঝাড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, নলিনী
বেরা, ভগীরথ মিশ্র, আফসার আমেদ, আবুল বাশারের মতো বিদগ্ধ সাহিত্যিকেরা।
এঁদের লেখনীতে মাঝে মাঝে শ্রম মুখর মানুষের জীবন চিত্র ধরা পড়লেও, অনিল ঘড়াইয়ের
লেখনীর শিল্পীত উত্তাপে যে ভাবে ঝল্সে উঠেছে ঐ অন্ত্যজ শ্রেণীর অব্যক্ত ভাষা। যে
ভাবে অনিল ঘড়াই অন্ত্যজের অন্দর মহলে ঢুকে গেছেন – তাঁর ধারে কাছে আর কেউ নেই। তাইতো তাঁর আত্মকথাতেই শোনা যায়
–‘এখন ঘোরতর শীতকাল। এই মাত্র আমার চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। আমি সামুদ্রিক পাখির
খোঁজ করতে যাব। দোহাই আমাকে একটু একা হাঁটতে দিন।’ (‘কাক’/ ‘সাইবেরিয়ার পাখি’)। এই
একা হাঁটাই অনিল ঘড়াইয়ের শিল্পী মনের অভিপ্রায়। তারাশঙ্কর কাহার, বাগদি, দুলে,
ডোম, আউল-বাউল, বোষ্টমি প্রভৃতি অন্ত্যজ মানুষের যাপন প্রণালী তুলে ধরে রাঢ়বঙ্গের
রূপকার হিসেবে খ্যাতিবান হয়ে আছেন। সেই ধারা স্রোতে সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী এমনকি,
ভারতবর্ষ ছাড়িয়েও বিস্তৃততর ভৌগলিক পটভূমিকায় তাঁর সাহিত্য চিন্তা প্রতি
ফলিত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের ঐ প্রান্তজ কুলের একে বারে গভীরে, আরো ভেতরে ঢোকার
স্পর্ধা একমাত্র অনিল ঘড়াই দেখাতে পেরেছেন। কেবল তাঁর স্বশ্রেণীই শুধু মাত্র নয়,
আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ অন্ত্যজ মানব শ্রেণী সম্পর্কে অজস্র টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার
জোরেই। যা, কেবল নিটোল গল্প কথা নয়, নন্দনতত্ত্ব মাত্র নয় – প্রান্তজ জীবনের হৃদয়
পাঠের মধ্য দিয়ে মানবিক চিত্রায়নের দায়বদ্ধতায় কঠিন বাস্তবের পরতে পরতে উন্মোচিত
হয়ে উঠেছে তাঁর লেখন সত্ত্বা। মাটি ও মানুষের অন্তর্দেশ থেকে উঠে আসা তাঁর সাবলীল
ও স্বচ্ছ সাহিত্যের ভাষা, শব্দ, উপমা, রূপকল্পও ব্যঞ্জনাময় উপলব্ধি।
ফলে, দলিত সাহিত্যের সবচাইতে
শক্তিশালী ধারা অনিল ঘড়াইয়ের বলিষ্ঠ লেখনীতেই উন্মোচিত হয়ে উঠল। সমাজের অপাংক্তেয়
চির অবহেলিত মানব জীবন সম্পর্কে প্রগাঢ় সমবেদনায় তাঁর আত্ম উপলোব্ধি এবং
সত্যানুসন্ধানের নগ্ন বাস্তবের দ্বন্দ্ব-ঐ জীবনকে যে ভাবে সাহিত্যে আলোকপাত
করেছেন, তাতে শিল্পী মনের সদিচ্ছা ও সৎ প্রচেষ্টা এমনকি, ভীষণ রকম দায়বদ্ধতা লক্ষ্য
করার মতো।
অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী,
ঝাড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, শৈবাল মিত্র,
ভগীরথ মিশ্র সহ সমসাময়িক এক ঝাঁক দায় বদ্ধ লেখক বাংলা সাহিত্যের যে দশা ও দিশা
বদলে দিতে চলেছেন, তাঁদের মধ্যমণি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক অনিল ঘড়াইয়ের সাহিত্যে
একাধারে যেমন শরৎ-মানিক-তারাশঙ্কর ও মহাশ্বেতা দেবীদের কথা শোনা যায়; তেমনি দলিত
মানুষের আত্ম উন্মোচনে বাংলা সাহিত্যের ব্রাহ্মণ্য বাদকে সুতীব্র চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে
দেয় তাঁর লেখনীর জ্বালাময়ী অভিব্যক্তিতে। এমনকি, বাংলা সাহিত্যের
প্রবাহমান ঐতিহ্যের ধারা বদলে দেয় লেখকের প্রবল আত্ম বিস্ফোরণে। কি, কিশোর
সাহিত্য, কি গল্প শিল্প, কি উপন্যাস শিল্প, এমনকি, কাব্য-শিল্পের সর্বত্রই ঐ
অন্ত্যজ শ্রম মুখর মানুষের বেদগান শুনিয়েছেন প্রখরতর মানব ভাবনায় ঋদ্ধ শিল্পী অনিল
ঘড়াই।
এইরূপ
একজন সাহিত্যিককে যে ভাবে দেখেছি ও জেনেছি তার জোরেই ‘যেমন দেখেছি তাঁকে – অনিল আলোয়’ প্রবন্ধ সৃষ্টির
সফলপ্রয়াস। যা সুনীল মাজি ও ভবেশ বসুর সম্পাদনায়
২০১৫ সালে ‘অনিল ঘড়াই পরিক্রমা’ গ্রন্থে স্থান পায়।
- ড. চঞ্চল কুমার মণ্ডল
তাং - ০৬.০৬.২০২০