প্রসঙ্গ ‘নীল দুঃখের ছবি’ : কাকমারা সম্প্রদায়ের ইতিকথা ড. চঞ্চল কুমার মণ্ডল

 

প্রসঙ্গ ‘নীল দুঃখের ছবি’ : কাকমারা সম্প্রদায়ের ইতিকথা

ড. চঞ্চল কুমার মণ্ডল

প্রসঙ্গ ‘নীল দুঃখের ছবি’ : কাকমারা সম্প্রদায়ের ইতিকথা

 

মানুষের জন্যই  মানুষের সাহিত্য। যুগে যুগে প্রত্যেক শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকের ভাবনা মানুষকে নিয়েই। মানবজীবনকে নিয়েই তাঁদের কারবার। মানব জীবনের ক্ষুধা-প্রেম-বঞ্চনা, শোষণ-উৎপীড়ন, আনন্দ-উৎসব সবই তাঁদের লেখনীতে ধরা চাই। তাই তাঁরা খুঁজতে থাকেন ‘গোটা মানুষের মানে’আর আধুনিক কথাসাহিত্যিক অনিল ঘড়াই বুকের অনন্ত ভালোবাসা দিয়ে ব্রাত্য-অবহেলিত মানবাত্মার ক্রন্দন ধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কথামালাতেপৃথিবীর মানচিত্র থেকে ঝরে যাওয় বহু অনাহুত নর-নারীর আর্তনাদ তিনি যেন ঐ সকল মানুষের বুকে কান পেতে শুনেছেন। রেলওয়ের চাকরির সুবাদে ঘুরে-বেড়িয়েছেন সাউথ-ইস্টার্ন, ওয়েস্টার্ন অঞ্চলেবিহারের প্রান্তিক জন-অরণ্যেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের অনেকটা আয়ু। জনজীবনেই ঘটেছে তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি ও বিস্তার।

‘নীল দুঃখের ছবি’ উপন্যাসে ব্রাত্য-চির অবহেলিত, সমাজের একেবারে নিম্ন-জাতি তথা, কাকমারা সম্প্রদায়ের জটিল-কঠিন যাপনচিত্র তুলে ধরেছেন জীবন-শিল্পী অনিল ঘড়াই কাকমারা জনজীবনের নিত্যদিনের ব্যথা-বেদনা, তাদের বেঁচে থাকার, জীবনধারণের সমস্যা-সঙ্কটঘন চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অতি সজীব রূপে।

          উপন্যাসের কাহিনী পটে রয়েছে দুই জীর্ণকঙ্কালময় চরিত্র তথা, দিগম্বর ও পীতাম্বর নামে দুই কাকমারা সম্প্রদায়ের নেতৃ স্থানীয় চরিত্র। এই দু’ই ভাইয়ের মধ্যে ভিক্ষাম্বরের পুত্র দিগম্বর, যে উপন্যাসের যথার্থ নায়কও। ভিক্ষাম্বরের একমাত্র মেয়ে তথা, দিগম্বরের বোন বিন্দিয়ার জীবন সমস্যার জটিলতর চিত্র উপন্যাসের শুরু থেকেই লক্ষ্য করা যায়। যাকে বিয়ে দিয়েও সে স্বামী বৃন্দাবনের সংসার থেকে বিতাড়িতা হয়ে এখন পিতার আশ্রয়ে রয়েছে। পার্শ্ব চরিত্র হিসাবে অবস্থান করেছে ভিক্ষাম্বরের স্ত্রী  ফুলঝুরি, পিতাম্বরের স্ত্রী ঝুমরি সহ দিগম্বরের শালা কংস। বিন্দিয়ার ভাঙা-চোরা জীবনের কাহিনী এগোতে এগোতে হঠাৎ উপকাহিনী হিসাবে উপন্যাসে উঠে এসেছে আরো এক বিক্ষত নারী বিদ্যাধরীর জীবনালেখ্যসম্ভ্রান্ত পরিবারের এক বধূ বিদ্যাধরী স্বামী-শাশুড়ির অত্যাচারে হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তির আশ্রয়ে এই কাকমারা সম্প্রদায়ের একজন হয়ে উঠেছে। যাযাবর কাকমারা সম্প্রদায় এই অসহায় নারীকে তাদের সারল্যপূর্ণ মহান ঔদার্যের সঙ্গে গোষ্ঠীজীবনে আশ্রয় দেয়। বিদ্যাধরীর ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবন-ইতিহাস যেন স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজ শোষিত-চিরলাঞ্ছিতা নারী-জীবনের সামাজিক অবস্থানটি। জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া সংসারচ্যুত নারী কিভাবে বাধ্য হয় পতিতা-জীবন বেছে নিতে। এভাবে, ঔপন্যাসিক দুঃখের নীল সমুদ্র মন্থনকারী অজস্র ভাঙা-চোরা জীবনের জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন যা, ‘নীল দুঃখের ছবি’ হয়ে ফুটে উঠেছে ঐ যাযাবর শ্রেণীর প্রতিটি সজীব অথচ ম্লানমুখগুলো।

          এই কাকমারা সম্প্রদায়ের জীবন যেমন কঠিন তেমনই এদের জীবিকাও অত্যন্ত সঙ্কটপূর্ণএরা গ্রামের জনবসতী থেকে দূরে ফাঁকা জায়গায় বাঁধের ধারে, যত্রতত্র তাঁবু খাঁটিয়ে কিছু কাল বসবাস করে। ঐ যাযাবর জীবনে তদের স্ত্রীলোকেরা গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করেসঙ্গে তুকতাক, জড়িবুটির, উদকাঠি-নজরকাঠি তৈরী করে পাড়ায়-পাড়ায় বিক্রি করে। এরা গাঁয়ে ঢুকলে লোকের সন্দেহ বাড়ে। কেউ কেউ আবার মিথ্যে সন্দেহে পিটিয়েও মারে। শ্মশান থেকে শবদেহ পোড়ানোর আধপোড়া কাঠ এদের রান্নার জ্বালানি। এমনকি, মৃতের ব্যবহৃত থালা-গেলাস; ফেলে দেওয়া অশৌচ হাঁড়ি-কুড়ি সবকিছুই এরা স্বচ্ছন্দে তুলে এনে বাসন হিসাবে ব্যবহার করে।

অন্ত্যজ জীবনের কথাকার অনিল ঘড়াই এই রূপ একটি বিলুপ্তপ্রায় জনজাতির জীবন ও জীবিকা সঙ্কটের ইতিবৃত্তকে পরম সমবেদনার তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এইরূপ যাযাবর শ্রেণীর জীবন-জীবিকার সমস্যা-সঙ্কট নিয়ে লেখা উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যে সত্যিই অভিনব ও তাৎপর্যপূর্ণ।

         

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন