‘কচি সংসদ’ গল্পে ব্যঙ্গমিশ্রিত কৌতুকহাস্য
‘কচি সংসদ' গল্পটি নগরজীবনের পটভূমিতে রচিত। এই গল্পের মল ব মিশ্রিত - কৌতুকহাস্য। গল্পের সংলাপেই তার দৃষ্টান্ত স্পষ্ট। গল্পের বিষয়ের মধ্যে আছে হাস্যরস।
শরৎকালের শারদীয়া পূজার ছুটিতে ব্রজেন উকিল সস্ত্রীক দার্জিলিং বেড়াতে আসার সংবাদে কাহিনীর শুরু। ব্ৰজেন গিন্নির পরিচিত টুনিদিদি ও তার ননদ, সরােজিনী, সুকুমাসি এবং মংকি মিত্তিরের বউ তার তেরােটি ছানাপােনা সহ সেখানে উপস্থিত। ফলে আড্ডাটা বেশ জমে উঠল। সেখানে ব্রজেন উকিল পরিচিত হয় ডুমরাওলের মােক্তার নকুড় চৌধুরীর সঙ্গে যিনি আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে সকলের। কাছেই ‘মামা’ হিসেবে চিহ্নিত। তার পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নে কেষ্ট নব্য আধুনিকতার ধ্বজাধারী। ভাববাদী এই যুবক ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং অবসর সময়ে আমােদ প্রমােদে ডুবে থাকে। সে চিরায়ত প্রেম ও বিবাহের ঘাের বিরােধী। তাই অত্যন্ত সচেতনভাবেই সে এই ব্যবস্থাকে ভাঙতে চায়। তার প্রেম পদ্ধতি এরকম—
“প্রেম একটা ভূমিকম্প, ঝঞ্ঝাবাত, নায়াগ্রাপ্রপাত, আকস্মিক বিপদ—যাতে বুদ্ধিশুদ্ধি লােপ পায়। ...পুরােপুরি প্রেম বিবিক্ত কোর্টশিপ চাই। তাতে দুই যুবক-যুবতী থাকবে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, তাদের মাঝখানে থাকবে একজন অভিজ্ঞ মিডলম্যান – যে দুজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দুজনের অভ্যাস মতামত রুচি এইসব বিচার বিবেচনা করে সামঞ্জস্য বিধানের দিন ঠিক করবে। তারপরে হবে বিবাহ।”
এহেন কেষ্ট নকুড় মামাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে সে বিবাহ করতে দার্জিলিং-এ আসছে। মুনসাইন ভিলায়। সেই টেলিগ্রাম পেয়েই দার্জিলিং-এ নকুড় মামার আগমন। আগমন ঘটে কচি সংসদ’ ক্লাবের সদস্যদেরও। কেষ্ট যে তাদেরই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।
কেষ্টর বিবাহের পাত্রী ভুবন বােসের ভগিনী পদ্মমধু বােস। সন্ধ্যাবেলায় সেন্ট ভিলায় কেষ্ট আসে। ব্ৰজেন উকিলের মধ্যস্থতায় কোর্টশিপের সূচনা হয়। দীর্ঘ কৌতৃকঘন জেরার শেষে তাঁর ঘােষণা
“তােমাদের মােটেই মতে মিলবে না, রফা করাও চলবে না, আমি এই হুকুম দিয়ে লিখলুম – Napoo, nothing doing, কেস এখন মুলতবী রইল। এক বৎসর নিজের নিজের মতামত বেশ করে রিভাইজ কর, তারপর আবার অত্র আদালতে হাজির হইবা।”
ব্রজেন উকিলের এই সিদ্ধান্তে রুষ্ট কেষ্ট বলে—
“আপনি আমার সিস্টেম কিছু বুঝতে পারেন নি। আপনি যা করলেন সে কি একটা টেস্ট হল? শুধু ইয়ারকি। আপনাকে মধ্যস্থ মানাই ঝকমারি হয়েছে।”
এই ঘটনার পর থেকে কেউ আর কেষ্টর খোঁজ পায় না। শেষে ব্রজেন উকিলের মীর মারফৎ জানা যায় নকুড় মামা, ভূবন বােস ও পদ্মমধু বােসকে নিয়ে কেষ্ট কলকাতায় গেছে। কলকাতাতেই কেষ্টর বিবাহ সম্পন্ন হয়। কোটশিপের নব্য-আধুনিকতার মােহ তখন দূর হয়ে গেছে।
বিবাহের দেড় মাস পরে ব্রজেন উকিলের সঙ্গে কেষ্টর দেখা হয়। নিজের অসৎ আচরণের জন্য সে ব্ৰজেন উকিলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ততদিনে ‘কচি সংসদ’ ক্লাব ছত্রভঙ্গ হয়েছে। কেষ্ট পরিবর্তে একটি নতুন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছে। নাম হৈ হয় সংঘ। কেষ্ট ও সস্ত্রীক ব্রজেন উকিল তার সদস্য। আসন্ন বড়দিনের ছুটিতে এই দম্পতি যুগলের পেশােয়ার গমনের সিদ্ধান্তে কাহিনীর সমাপ্তি।
পরশুরাম গল্পটির মধ্য দিয়ে যেভাবে পাশ্চাত্য অনুকরণকে চিহ্নিত করেছেন এবং সেই প্রভাব কাটিয়ে ভারতীয় জীবনাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা প্রশংসাযােগ্য। এবিষয়ে তিনি সুক্ষ্ম মননধর্মীতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পটি যথাযথ বিদেশী শব্দের প্রয়ােগ ও নাটকীয় রসে জারিত হয়ে পরিবেশিত। সঙ্গে হাস্যরসের পরিবেশনাও শিল্পসম্মত যা আমাদের রক্তাক্ত করে না, ক্ষতবিক্ষত করে না, বরং প্রাচীন আদর্শ ঐতিহ্যকে স্মরণ করায়।